এ্যাসাইনমেন্ট

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমেই জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব – এর যৌক্তিকতা নিরুপণ

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সমাজিক পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমেই জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব এর যৌক্তিকতা নিরূপণ। এইচএসসি সমাজকর্ম ২য় পত্র ৮ম সপ্তাহের এসাইনমেন্ট ২০২২ সমাধান।

নির্দেশনা

  • ক. মৌলিক মানবিক চাহিদার ধারণা ব্যাখ্যা করা
  • খ. সম্প্রতিক তথ্যের আলােকে বাংলাদেশে মৌলিক মানবিক চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি
  • গ. বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার অপূরণজনিত সমস্যা বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদা
  • ঘ. পূরণের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের উপায়
  • ঙ. জীবন মান উন্নয়নের পক্ষে যৌক্তিকতা

ক) মৌলিক মানবিক চাহিদার ধারণা

মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। মানুষ দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুরই চাহিদা অনুভব করে। কিন্তু সকল প্রকার চাহিদা মৌলিক মানবিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত নয়। প্রধানত দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং সামাজিক জীবনের উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে সকল চাহিদা পূরণ করা অপরিহার্য, সেগুলোই মৌলিক মানবিক চাহিদার পর্যায়ভুক্ত। মৌলিক মানবিক চাহিদা মূলত দু’ধরনের চাহিদার সমন্বয়। যেমন-

  • (ক) মৌলিক চাহিদা (Basic Needs),
  • (খ) মানবিক চাহিদা (Human Needs)

(ক) মৌলিক চাহিদা :

মানুষসহ যেকোনো জীবন্ত প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা, দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য যেসব চাহিদা পুরণ করা অপরিহার্য তাকে মৌলিক চাহিদা বলে। একে জৈবিক বা দৈহিক চাহিদাও বলা হয়। এ চাহিদার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মানুষসহ সকল জাবস্ত প্রাণীর বেঁচে থাকা এবং দৈহিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য এটি পূরণ করা অত্যাবশ্যক। মৌলিক চাহিদার আওতায় আসে খাদ্য (food) ঘুম (sleep) ইত্যাদি।

(খ) মানবিক চাহিদা :

সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য যে সকল চাহিদা পূরণ একান্ত অপরিহার্য, সেগুলোকে মানবিক চাহিদা বলে। মানবিক চাহিদা অনেক সময় সামাজিক চাহিদা হিসবে আখ্যায়িত হয়। এটা শুধু মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সমাজবদ্ধ সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মানবিক চাহিদা পূরণ করা সামাজিক জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ চাহিদাগুলো মানুষকে সমাজের অন্য প্রাণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা দিয়েছে। মানবিক চাহিদা হলো— বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি।

মানুষের বেঁচে থাকা, জীবনের বিকাশ এবং সভ্য-সামাজিক জীবনযাপনের জন্য যে সকল উপকরণ একান্তই অপরিহার্য, যার কোনো বিকল্প নেই, তাদের সমষ্টিকে মৌলিক মানবিক চাহিদা বলে। ডেভিড জেরি এবং জুলিয়া জেরি (২০১৫) প্রণীত “কলিন্স সমাজবিজ্ঞান অভিধান” -এর সংজ্ঞানুযায়ী, “মৌলিক মানবিক চাহিদা এমন একটি ধারণা, যাতে সকল মানুষ তাদের মানবিক গুণাবলির কারণে মৌলিক চাহিদা হিসেবে এগুলো পূরণে অংশগ্রহণ করে। সমাজজীবনে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের অত্যাবশ্যক পূর্বশর্ত হিসেবে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ বিবেচিত।

বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মাধ্যমেই জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব এর যৌক্তিকতা নিরূপণ

চাহিদার ধারণায় রবার্ট এল বাকরি (১৯৯৫) “সমাজকর্ম অভিধান” -এ বলেন, “চাহিদা হলো সেসব দৈহিক, মানসিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রয়োজন, যেগুলো মানুষের বেঁচে থাকা, কল্যাণ এবং বিকাশ ও পরিতৃপ্তির জন্য অপরিহার্য। মৌলিক মানবিক চাহিদার ধারণায় আবদুল হালিম মিয়া (২০০৬) বলেন, “মানুষ হিসেবে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপনের জন্য যে সকল গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ করা অপরিহার্য সেসব চাহিদাকেই মৌলিক চাহিদা বলে।

পরিশেষে বলা যায়, মানুষের জীবনধারণ, শারীরিক প্রবৃদ্ধি, মানকি বিকাশ ও পরিতৃপ্তি এবং সভ্য ও সামাজিক জীবনযাপন ও তার উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে চাহিদাগুলো পূরণ অত্যাবশ্যক, সেগুলোর সমষ্টিকে মৌলিক মানবিক চাহিদা বলা হয়।

জেগে থাকা অবস্থাতেই কেবল নয়, ঘুমের মধ্যেও মানুষ চাহিদা পূরণে সচেষ্ট থাকে। কেননা ঘুমও হল একটি মৌলিক চাহিদা। স্থান-কাল ভেদে মানুষের জৈবিক চাহিদার ধরনের কোন পার্থক্য দেখা যায় না। তবে সামাজিক চাহিদা বিভিন্ন সমাজে ও বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের হয়ে থাকে। যেমন ক্ষুধা তৃষ্ণা, বিশ্রাম, আশ্রয়, চিকিৎসা ইত্যাদি জৈবিক চাহিদা গুলো গ্রাম-শহর, ধনী দরিদ্র সাদা-কালো, বাঙালি-অবাঙালি মুসলিম অমুসলিম, শিশু, যুবক, প্রবীণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রের মানুষের বেলায় প্রায় সমান।

অবশ্য এ সকল চাহিদা পূরণের কৌশল, ধরন ও ধারা এসমস্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বেশ তারতম্য পূর্ণ হয়। পাশাপাশি সামাজিক চাহিদা গুলো নানা ধরনের হলেও বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে কিছু কিছু সামাজিক চাহিদা ধরন ও তা পূরণে প্রকৃতি অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। যেমন শিক্ষা, নিরাপত্তা, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি সামাজিক চাহিদা গুলো বর্তমানে সার্বজনীন রূপ পরিগ্রহ রয়েছে।

খ) সম্প্রতি তথ্যের আলোকে বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার বর্তমান পরিস্থিতি

নিচের ৬টি চাহিদাকে মৌলিক মানবিক চাহিদা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

১. ক্ষুধা :

ক্ষুধা যে কোন প্রাণীর প্রধান চাহিদা। ক্ষুধা পেলে আমরা খাদ্য খাই। তাই জীবনের জন্য আমাদের প্রথম প্রয়োজন হলো র। মানুষ কেবল নয়, বরঞ্চ প্রাণী, পাখি, পতঙ্গ উদ্ভিদ সহ সকলেই তাদের জীবনের প্রায় পুরো সময় ব্যয় করে খাদ্য সংগ্রহ ও গ্রহণের পিছে। দেহের বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ও তাপ শক্তি উৎপাদন ইত্যাদির জন্য মানুষের দৈনিক প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য ও পানীয়। আর সুস্থ থাকার জন্য ওই খাদ্য এবং পানীয় হতে হবে নিরাপদ এবং সুষম। দৈহিক বৃদ্ধিই কেবল বৃদ্ধি নয়, মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও খাদ্য মানুষকে সক্ষম করে তোলে। খাদ্যের চাহিদা মানুষের সবচাইতে তীব্র। এই চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ বৈধ অবৈধ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করে।

২. বস্ত্র :

খাদ্যের পাশাপাশি মানুষের অন্যতম চাহিদা। মানুষ ছাড়া অন্য কারো বস্ত্র বা কর প্রয়োজন হয় না। মানুষের ত্বক পোশাক ছাড়া শীত, তাপ ও আব্রু রক্ষা করতে পারেনা।শুরু থেকেই মানুষ তাই কোনো না কোনো আবরণ বা আচ্ছাদন ব্যবহার করে আসছে। এক্ষেত্রে গাছের ছাল- পাতা, পশুর চামড়া ইত্যাদি প্রথমদিকের মানুষ ব্যবহার করতো।বস্ত্র এর পরবর্তী রূপান্তর। বস্ত্র বা পোশাক মানুষের জৈবিক ও সামাজিক চাহিদা মেটায়। পর্যাপ্ত পোশাক পরিধান করলে ওই মানুষকে সভ্য বলা হয় না। তাই শীত-তাপের বিধান মেনে চলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং লজ্জা নিবারণের জন্য মানুষের সব সময়ের চাহিদা পোশাক বা বস্ত্র। বর্তমানে সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বস্ত্রে বা পোশাকে বিভিন্ন ধরনের সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। বস্ত্রের চাহিদা তাই হাজার গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন এলাকায়, পরিবেশে, সংস্কৃতিতে বস্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন স্টাইল, ধরণ ও ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

৩. বাসস্থান :

প্রাণী, পাখি ও পতঙ্গের অন্যতম একটি চাহিদা হলো আশ্রয়। আর এজন্য মানুষ বিভিন্নভাবে তৈরী করেছে বাসন্তান। এটি অনেকটা জৈবিক চাহিদা। মানুষের বেলায় বাসস্থানের প্রয়োজন অন্যান্য পাখি পতঙ্গেরতুলনায় অনে বেশি। শান্তিতে ঘুমানোর জন্যে ঝড়-বৃষ্টি, শীত-তাপ হতে দেহকে রক্ষা করার লক্ষ্যে, জন্তু – জানোয়ার, চোর-ডাকাতের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে, সুষ্ঠু পরিবার গঠন ও পরিচালনার জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের জন্য এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ও নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় বাসস্থানের ভুমিকা খরব গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদির পার্থক্য অনুযায়ী বিশ্বের নান অঞ্চলের মানুষের বাসস্থানের ধরন ও আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ অধিকতর উষ্ণ ও আরামদায়ক বাসস্থান গড়ে তুলেছে। এর ফলে মানুষের। জীবন হয়ে উঠেছে আরও বেশি নিরাপদ, উপযোগী এবং সুখকর।

৪. শিক্ষা :

বলা হয় যে পুষ্টি জগতে শারীরিকভাবে মানুষ সম্ভবত সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় জন্ম নেয়। বেঁচে থাকা এবং প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য তাকে বিভিন্ন বিষয় শিখে কাজ করতে হয়। শেখার সামর্থ্য আবার মানুষেরই সবচেয়ে বেশি। তবে শিক্ষা হতে পারে প্রধানত দু’ধরনের, সংগঠিত বা আনুষ্ঠানিক এবং অসংগঠিত বা অনানুষ্ঠানিক। বর্তমানে শিক্ষা বলতেন যদিও বা অনানুষ্ঠানিক। বর্তমানে শিক্ষা বলতেন যদিও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কে ধরা হয় তবে এর বাইরেও বহু কিছু মানুষ নিজে নিজে শিখে নেয়। বিশ্বের অন্যান্য পশুপাখি হতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব একমাত্র শিক্ষার কারণে। মানুষ যত শিখে ততই শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিশ্বের যে দেশে শিক্ষার হার যত বেশি সেই দেশ তত বেশি উন্নত। বর্তমানে বলা হয় যে, বিশ্বের সকল দেশের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শিক্ষা মানুষকে শক্তিশালী করে; এজন্যই শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক চাহিদা।

৫. স্বাস্থ্য :

জীবনের চলার পথে মানুষ মাত্রই নানা ভাবে অসুস্থ, রোগগ্রস্ত ও আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থায় প্রয়োজন দেখা দেয় চিকিৎসা, পথ্য, খাদ্য ও পরিচর্যা। এগুলা যথাসময়ে ঠিকভাবে পেলে জীবন হয় সুস্থ, সবল ও স্মৃস্তি দায়ক। তবে কেবল শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, বরঞ্চ সামাজিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে মানুষকে সুস্থ থাকতে হয়, সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপরেই নির্ভর করে মানুষের শিক্ষা, কর্ম আয় উন্নতি ইত্যাদি। যৌগিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতা মানুষ ছাড়াও অন্যান্য সকল এর মৌলিক চাহিদা। মানুষ যেহেতু শ্রেষ্ঠ জীব তাই সে পারে নিজ ব্যবস্থাপনায় যথাযথভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিতৃপ্তি করতে। স্বাস্থ্যসেবা আধুনিক মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে “স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল”। অঙ্গীকারবদ্ধ”। কেননা,

৬. চিত্তবিনোদন :

বিনোদনে অংশ নেওয়া মানুষের একটি সহজাত চাহিদা। আদিকাল হতেই মানুষ সকল বয়সে এবং সকল সময়ে বিনোদনের সাথে জড়িত। শরীরে শক্তির জন্য যেমন প্রয়োজন খাদ্য তেমনি প্রশান্তির জন্য দরকার বিনোদনের। বিনোদন মানুষের চিত্তকে সুস্থ ও সবল রাখে। পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন, অবসর যাপন, নেতৃত্ব দান ইত্যাদি চিত্র বিনোদন প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। তাই বিশ্বের সব দেশেই সব সময় নাচ অভিনয় আবৃত্তি বিতর্ক ভ্রমণ পরিদর্শন ইত্যাদিতে মানুষ জড়িত থেকেছে। বর্তমানে রেডিও, টিভি, নাটক, বই,সিনেমা, পার্ক চিড়িয়াখানা কম্পিউটার, ক্রীড়া পর্যটন ইত্যাদি মানুষের চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপকরণ হিসেবে চালু রয়েছে। বিনোদনের মাধ্যমে ও উপকরণ অঞ্চল, সংস্কৃতি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদির কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে।

গ) বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদার অপূরণজনিত সমস্যা

মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান পাঁচটি সমস্যা নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. অপুষ্টি :

বাংলাে অন্যতম সামাজিক সমস্যা হল। এটি মূলত মৌলিক মানবিক চাহিদা অপূরণজনিত কারনে হয়। এর প্রধান শিকার হলো শিশু ও নারী। বাংলাদেশ প্রায় তিন চতুর্থাংশ শিশু ও দুই তৃতীয়াংশ নারী অপুষ্টিতে ভোগে। অপুষ্টির কারণে শিশুদের মধ্যে অন্ধ, প্রতিবন্ধী, কম বৃদ্ধি, খাটো হওয়া ইত্যাদি তে দেখা দেয়। তাছাড়া অপুষ্ট মায়ের সন্তান কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয় এবং শিশুর মৃত্যু হার বৃদ্ধি পায়। অপুষ্টির শিকার হয়ে অন্যান্য মানুষ অসুস্থ রোগগ্রস্ত দ্রুত বার্ধক্য এবং অকাল মৃত্যুর সম্মুখীন হয়। প্রয়োজনীয় আয়, শিক্ষা খাদ্য, চিকিৎসা, বস্ত্র, আশ্রয় ইত্যাদির অভাবে অপুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

২. স্বাস্থ্য হীনতা :

সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থ থাকার জন্য দরকার হয় খাদ্য পুষ্টি শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদন ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশে এ সকল মৌলিক চাহিদা সঠিকভাবে পূরণ হয় না বলে যে সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয় স্বাস্থ্যহীনতা তার মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহরের দরিদ্র মানুষদের মধ্যে নানা ধরনের রোগ ও অসুস্থতা লক্ষ্য করা যায়। দরকারি চিকিৎসাসেবা থাকায় এবং চরম দারিদ্র্যের কারণে অধিকাংশ মানুষের স্বাস্থ্য হুমকীর মুখে। তাছাড়া কুসংস্কার, ভেজাল, নকল খাদ্য ও ওষুধ স্বাস্থ্য সমস্যাকে আরও বেশী জটিল করে তোলে। অপুষ্টি ও রোগ শোকের কারণে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু কম। তাছাড়া শিশুমৃত্যু, প্রসূতি মৃত্যু, প্রতিবন্ধকতা এখানে অনেক বেশি।

৩. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা :

মানুষের জীবনের সবচেয়ে দরকারী উপাদান হলো শিক্ষা ও জ্ঞান। নিরক্ষর ও অজ্ঞ মানুষ নানা কুসংস্কারে আবদ্ধ থাকে এবং সঠিকভাবে উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। বাংলাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ নিরক্ষর। বলা হয় যে, “শিক্ষাই আলো “। অথচ শিক্ষার চাহিদা পূরণ হওয়াতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম অনুন্নত দেশ হওয়ার পিছনে এই নিরক্ষরতা বেশিরভাগ দায়ী। একথা বলতেই হয় যে, দেশের বহু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি খুব কম এবং বিস্তৃতির গতি সবচেয়ে মন্থর। শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক, বই-পুস্তক, স্কুল- কলেজ ইত্যাদি প্রচণ্ড অভাব এদেশের অধিকাংশ মানুষকে শিক্ষা হতে বঞ্চিত করে রেখেছে। ফলের জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। সৃষ্ট হচ্ছে অপুষ্টি, স্বাস্থ্য হীনতা সহ নানান ধরনের সামাজিক সমস্যা।

৪. গৃহ ও বস্তি সমস্যা :

গৃহ হচ্ছে মানুষের আশ্রয়স্থল। বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ গৃহহীন। ভূমির স্বল্পতা এর অন্যতম কারণ। দেশের সকল মানুষের জন্য পরিকল্পিত আবাসনের কোন পরিকল্পনা আজও গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ঢাকা সহ সকল শহরের অন্যতম সমস্যা হল বস্তি। দেশের শহর অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বসবাস করছে এখন বস্তিতে। বাসা বাড়ির স্বল্পতা এবং বস্তির বিস্তারের ফলে স্বাস্থ্যহীনতা, অপুষ্টি, নিরক্ষরতা, অপরাধ মাদকাসক্তি, সন্ত্রাস পতিতাবৃত্তি সহ নানা জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে শিশু ও নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুস্থ নাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত আবাসন অপরিহার্য। অথচ বাংলাদেশের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে।

৫.অপরাধ ও কিশোর অপরাধ :

আইন পরিপন্থী কাজ হলো অপরাধ। আর এই কাজটি কিশোর অবস্থায় করলে তাকে বলা হয় কিশোর অপরাধ। মৌলিক মানবিক চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ না হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। অর্থের অভাবে মানুষ যখন খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা অভাব পূরণ করতে পারেনা ঠিক তখনই চুরি ছিনতাই, ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি অসচ্ছলতার অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি অসচ্ছলতার কারণে ঘুষ, দুর্নীতি মজুতদারী, চোরাচালান হতে শুরু করে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা, নেশা, সন্ত্রাস ইত্যাদি বাংলাদেশ বেড়েই চলছে। পর্যাপ্ত বিনোদনের অভাবে এদেশের মানুষ নানাভাবে দিন দিন বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

ঘ) বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের উপায়

মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা সমস্যার সমাধানে গৃহীত পাঁচটি পদক্ষেপ নিচে বর্ণনা করা হলো:

১. খাদ্য :

বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০) জাতীয় কৃষি নীতি ও সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্য রেখে কৃষি খাতের সরকারের উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি উপকরণের ভর্তুকি বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করা, কৃষিঋণের আওতা বৃদ্ধি এবং প্রাপ্তি সহজীকরণ করা হয়েছে। মাটির গুনাগুন বজায় রাখা এবং অধিক ফসল ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুষম সার ও জৈব সারের ব্যবহার কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা মেটাে ভেষজ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষিখাতের সার্বিক উন্নয়নকে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে।

২. বস্ত্র :

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৩ সালের মধ্যে বস্ত্রের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং বস্ত্র রপ্তানিতে মাত্রা নির্ধারণ করে দেশের প্রথম বস্ত্র নীতি ঘোষণা করে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) বস্ত্রের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে 2005 সালের মধ্যে বার্ষিক মাথাপিছু 17 মিটার বস্ত্র প্রাপ্তির 62% নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।বাংলাদেশের রপ্তানিমুখা পোশাক শিল্পের শতকরা ৪০ থেকে 85 ভাগ বস্ত্রের দা দেশীয় শিল্প থেকে আসে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্পে মানে 50 লক্ষ লোক নিয়োজিত রয়েছে। বর্তমানে বন্ধ মিলগুলো পর্যায়ক্রমে চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বস্ত্ৰ খাতের উন্নয়নে বস্ত্র প্রযুক্তিবিদ ও বস্ত্র বিষয়ক দক্ষ জনশক্তির চাহিদা পূরণে পাঁচটি স্টাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, 6 টি টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট তৈরি করা হয়েছে।

৩. বাসস্থান :

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর গৃহায়নের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ১৯৯৭-৯৮ গৃহায়ন তহবিল গঠন করা হয়। এ তহবিল দ্বারা এখন পর্যন্ত 3.55 লক্ষ লোক উপকৃত হয়েছে। গৃহনির্মাণ কর্মসূচির আওতায় ফেব্রুয়ারি 2015 সাল পর্যন্ত ৬১,০৯২ গৃহ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। সারাদেশে মোট ৫১৩ টি এনজিও এবং 64 জেলার 450 টি উপজেলায় গৃহায়ন ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন। করা হয়েছে। শহর অঞ্চলের ভাসমান জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কয়েকটি পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ভূমিহীন গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে গ্রহণ করা হয় আশ্রয় প্রকল্প। ১৯৯৭-২০০২ সাল পর্যন্ত সময়ে 300 কোটি টাকা ব্যয়ে 50 হাজার পরিবারকে এ প্রকল্পের আওতায় পুনর্বাসন করা হয়।

৪. শিক্ষা :

সাংবিধানিক দায় বদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার প্রতিপালনে ” সবার জন্য শিক্ষা ” নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকা কে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দান এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিরক্ষতা দূর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার যুগোপযোগী ও কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ – প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন সহ নানাবিধ উন্নয়ন ও সংস্কারধর্মী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।বাধ্যতামূলক শিক্ষা দান এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই নিরক্ষতা দূর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার যুগোপযোগী ও মুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন, পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন সহ নানাবিধ উন্নয়ন ও সংস্কারধর্মী কাযক্র হাতে নেওয়া হয়েছে।

৫. স্বাস্থ্য :

সরকারের সাংগঠনিক দায় বদ্ধতা হল নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা এর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা শিশুদের মারাত্মক ছয়টি রোগ (ডিপথেরিয়া, ম নাস, পোলিও, হুপিং কফ যক্ষা ও হাম)। প্রতিরোধের জন্য ১৯৭৯ সাল থেকে টিকাদান কর্মসূচি চালু রয়েছে। দেশকে পোলিও মুক্ত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী জাতীয় টিকাদান দিবস পালিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি-২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। মাঠকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী মাধ্যমে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ এবং ভিটামিন (এ) এর অভাবজনিত অন্ধত্বের দূরীকরণ কৃমিনাশক ঔষধ বিতরণ ও টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

ঙ) জীবন মান উন্নয়নের পক্ষে যৌক্তিকতা

জীবনযাত্রার ধরন বলতে ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজনীয় উপকরণ, যেমন – অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও ভোগ্যপণ্য ইত্যাদিকে বোঝায়। অর্থাৎ যে যত বেশি ভোগ করে এবং যত বেশি উন্নত সুন্দর পরিবেশে জীবনযাপন করে তার জীবনযাত্রার মান তত বেশি উন্নত বলে বিবেচিত হয়।সুতরাং জীবনধারণের মানকে জীবনযাত্রার মান বলা হয়। যে দেশের জনগণ উন্নত পরিবেশে উন্নতমানের জীবনধারণের সকল সুবিধা ভোগ করে সে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান তথা জীবনধারণ তত উন্নত বলে ধরে নেওয়া হয়। তাই আমেরিকা, কানাডা, কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানসহ উন্নত দেশসমূহের জনগণের জীবনধারণ প্রক্রিয়া অতি উন্নত।

জীবনযাত্রার উন্নয়নে বিভিন্ন উপায় গ্রহণ করতে হবে। যেমন:

  • ১.জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ;
  • ২. দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি
  • ৩.আয়ের সুষম বণ্টন
  • ৪.যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন;
  • ৫.মূলধন গঠন;
  • ৬.শিল্পোন্নয়ন;
  • ৭.কৃষিক্ষেত্রে আধুনিকায়ণ ও কৃষি শিক্ষার প্রসার ;
  • ৮.নিরক্ষরতা দূরীকরণ;
  • ৯.সুশাসন নিশ্চিত করা;
  • ১০.সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার;
  • ১১.মুদ্রাস্ফীতি রোধ ;
  • ১২.প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ;
  • ১৩.শ্রমশক্তির পরিমাণ বাড়ানো ;
  • ১৪.আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ;
  • ১৫. নৈতিক শিক্ষার প্রসারণ;

উল্লেখিত উপায় গুলো বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিলে তাহলে জনগনের মাথাপিছু আয় বাড়বে। জীবন মান উন্নয়ন হবে।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button