নোটিশ

স্বাধীনতা দিবস রচনা ২০২৪ | ২৬ শে মার্চ এর রচনা, প্রবন্ধ ও অনুচ্ছেদ

স্বাধীনতা দিবসের রচনা, প্রবন্ধ বা ২৬ শে মার্চ রচনা, আপনি যাই খুজছেন! আজকের আমাদের পোষ্ট আপনার জন্য বিখ্যাত রচনা গুলো তুলে ধরা হবে। আমরা সকলেই জানি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬শে মার্চ। এই দিনটি সকল বাংলাদেশীদের কাছে একটি গৌরবময় এবং শ্রদ্ধা, সম্মান জানানোর দিন। কারণ এই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং এই স্বাধীনতা ঘোষণা কে কেন্দ্র করে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে শহীদদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই আজ আমরা আপনাদের জন্য ২৬শে মার্চের রচনা, প্রবন্ধ ও অনুচ্ছেদ নিয়ে হাজির হয়েছি।

আপনারা চাইলে আমাদের এখান থেকে এই সকল স্বাধীনতা দিবসের রচনা, প্রবন্ধ ও অনুচ্ছেদ ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ এই স্বাধীনতা দিবসে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পালন করা হয়। আর সেখানে এগুলো ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তাই আপনারা যারা সময়ের অভাবে রচনা, কবিতা ও ছন্দ তৈরি করতে পারছেন না তারা আমাদের এখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।

২৬শে মার্চের রচনা

বাংলাদেশের ইতিহাসের যে সকল গুরুত্বপূর্ণ দিবস রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এবং গৌরবময় দিন হচ্ছে ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের রচনা তৈরি হয়েছে। আর এ সকল রচনা সমূহ শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পর্যায় রচনা লিখতে হয়, তাই এই সকল রচনাগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ

স্বাধীনতা দিবসের রচনা

এছাড়াও স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিষ্ঠানসমূহ রচনা প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। সেখানে অংশ রচনা প্রতিযোগিতা নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে রচনা লিখে থাকে। আর তাদের জন্য ২৬শে মার্চ এর রচনা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা তাদেরকে উদ্দেশ্য করে এবং আপনারা যারা ২৬শে মার্চের রচনা লিখতে চান তাদের জন্য আমরা নিম্নে কিছু রচনা নাম উল্লেখ করেছি যেখান থেকে আপনারা রচনা নামসমূহ সংগ্রহ করে নিজেদের মতো করে তৈরি করতে পারবেন।

  • স্বাধীনতা দিবস
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস
  • ২৬শে মার্চ ( স্বাধীনতা দিবস)

স্বাধীনতা দিবস রচনা (৫০০ শব্দ)

ভূমিকা: বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা রয়েছে সুদীর্ঘ রক্তঝরা ইতিহাস। এক সাগর রক্ত ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এ স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তান লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের শাসন শোষণ ও বঞ্চনার মাধ্যমে দেশকে পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রকম ভাবে শোষণ করা শুরু করে। এবং এর প্রথম আঘাত হানে আমাদের সংস্কৃতির উপর। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মানুষ স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, তারপর অনুষ্ঠিত হয় ৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন,৬৬ সালের ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বশেষ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ: ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট নামে এদেশের নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যা চালায়। তারা তৎকালীন ঢাকার ইউপিআর সদরদপ্তরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন আবাসিক হলে ছাত্র দের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় আশেপাশে যাদের পায় তাদের এ ক্রসফায়ার করে ঘটনাস্থলে মেরে ফেলা হয়। তারা শুরু করে পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যা। এরপর বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ক্রসফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। এদেশের নিরীহ মা বোনদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জোর করে ধর্ষণ করে। বীর বাঙালি তখন গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। সর্বশেষ ভারতের মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে 16 ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।

স্বাধীনতার ঘোষণা: ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। গ্রেপ্তারের পূর্বে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। পরে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়।

গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন: ১৯৭১ সালে 10 এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কারন সে সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে: ৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তি বাহিনী ও ভারতের মিত্র বাহিনী যৌথভাবে হানাদার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৪ থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করলে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। নিশ্চিত পরাজয় দেখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের জ্ঞানীগুণী বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে ।

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়: 16 ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ঢাকার সোহার্দী উদ্যানে 93 হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ফলে বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে।

উপসংহার: নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর লক্ষ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন করেছে এই স্বাধীনতা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে আমরা আমাদের জীবন দিয়ে রক্ষা করব। রুখে দাঁড়াবো স্বাধীনতার বিপক্ষে সকল অপশক্তিকে। সকলে মিলে একসাথে কাজ করে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।

স্বাধীনতা দিবস রচনা (১০০০ শব্দ)

ভূমিকাঃ                      

‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়. . .’

                                                                       -রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।

মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। তার এই জন্মগত অধিকার যখন অন্যের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় তখনই সে প্রতিবাদ করে ওঠে। সর্বস্বের বিনিময়ে নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি শোষকদের বর্বরোচিত শোষণের নির্মম শিকার হতে হয়। পরাধীনতার শৃংখলে আবদ্ধ বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মৃত্যুপণ সংগ্রাম শুরু করে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ; তিরিশ লক্ষ প্রাণ আর দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ বাংলাদেশ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর এই গৌরবময় দিনটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে সমাদৃত।

ঐতিহাসিক পটভূমিঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের স্বপ্নবীজ মূলত বপন করা হয়েছিল সেই ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগের সময়ই। পরবর্তীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্রমাগত শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্যমূলক আচরণ, ন্যায্য অধিকার প্রদানে অস্বীকৃতি প্রভৃতি আন্দোলনের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার এই পরোক্ষ সংগ্রাম ১৯৭১ এ এসে অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অনিবার্য মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় ‘বাংলা’ ভূখন্ড।

ঐতিহাসিক পটভূমির ধারাক্রমঃ ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-বেনিয়াদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তান দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোজন-যোজন দূরত্ব সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্থান ও বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয় নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান। অদ্ভূত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকদের অনাচার-অত্যাচার আর সর্বক্ষেত্রে চরম বৈষম্য-বঞ্চনার স্বীকার হয় বাঙালি জাতি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেবল অর্থনৈতিক শোষণই নয় বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। তখনই ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে।

১৯৫২ সালে উর্দুকে আবারও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। বর্বর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মিছিলে গুলি চালালে শহিদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। শহিদদের এই পবিত্র রক্তই যেন বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকার ছবি এঁকে দেয়।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। মুসলিম লীগের অসহায় ভরাডুবিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতার ভিত। ১৯৫৬ সালে পুনরায় সরকারি ভাষায় বিতর্ক, আইয়ুব খানের অপশাসন, পাঞ্জাবি ও পশতুনদের ঋণ বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া প্রভৃতি কারণে বাঙালিদের মনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে।

১৯৬৬ সালে বাঙালির স্বাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক ‘ছয়-দফা’ দাবি উত্থাপিত হয়। গণবিক্ষোভ প্রতিহত করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সামরিক শাসনের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর চালাতে থাকে অত্যাচার, নিপীড়ন। ১৯৬৮ সালে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানাকে মিথ্যা ও সাজানো ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি অপশক্তি ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ছেড়ে দেয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরও ক্ষমতালিপ্সু শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল সমাবেশের ডাক দেন। সমাবেশের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ বলে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এমন একটি উদাত্ত আহ্বানের জন্যই এতদিন যেন অপেক্ষা করেছিল বাঙালি। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। সর্বত্র শুরু হয় তুমুল আন্দোলন।

অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে বর্বর পাকিস্তানি পশুশক্তি নিরস্ত্র-ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এশিয়া টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী, “Indians are bastards anyway”. সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন- “তিরিশ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।” সে পরিকল্পনা মতোই ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি আর্মি অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।

বাঙালিদের প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা অর্জনঃ ২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান। তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য সংগঠকবৃন্দ অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। সর্বস্তরের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম, বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের সর্বাত্মক সহায়তা, বিশ্ব গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা তদুপরি তিরিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অবশেষে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ও অসাম্প্রদায়িক, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল স্বতন্ত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি বাঙালির জীবনে বয়ে আনে একই সঙ্গে আনন্দ-বেদনার অম্ল-মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে প্রাপ্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়েও স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর আসে আত্মত্যাগ ও আত্মপরিচয়ের বার্তা নিয়ে। স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আসে এই দিন।

বর্তমান বাস্তবতাঃ ‘কি দেখার কথা কি দেখছি. . . তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি. . .’ স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বর্তমান বাস্তবতা পর্যালোচনা করলে গায়ক হায়দার হোসেনের এই গানটিই যেন করুণ সুরে বেজে ওঠে মনের কোণে। তিরিশ নয়, তেতাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে স্বাধীনতার। সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ সমাজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি আমাদের। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, বেকারত্বের দুর্বিপাকে এখনও আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি। মূল্যবোধের অবক্ষয়, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। স্বাধীনতার চেতনা যেন ম্লান হয়ে যেতে বসেছে আর আমরা ক্রমশই যেন পিছিয়ে যাচ্ছি।

সংকট উত্তরণের উপায়ঃ সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশার কথা হলো, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতার ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। এই প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার দীক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। এ জন্য এদের হাতে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস তুলে দেয়া জরুরি। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস সংগ্রহের মাধ্যমে ইতিহাসবিকৃতি রোধের মাধ্যমে তা সম্ভব হতে পারে। দল কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে কল্যাণমুখী রাজনীতির চর্চা করতে হবে।

উপসংহারঃ                              পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত

ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,

নতুন নিশান উড়িয়ে,

দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক

এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।

কবি শামসুর রাহমানের মতো প্রতিটি বাঙালির আত্মপ্রত্যয়ী আহ্বানে এসেছে স্বাধীনতা। অর্জিত এই স্বাধীনতা রক্ষা ও এর চেতনা বাস্তবায়নে সব ধরণের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হতে হবে আমাদের।

স্বাধীনতা দিবস রচনা (১৫০০ শব্দ)

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
পৃথিবীর এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি–প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে।
— শামসুর রাহমান
কবিতার এ ছত্রেই লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। স্বাধীনতার বীজপত্র হিসেবে এমন একটি কবিতাই যথেষ্ঠ। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। অনাহারী একজন গৃহহীন পথের লোকও ব্যক্তিগত জীবনে স্বাধীনতা কামনা করে। স্বাধীনতার অর্থ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে সার্বভৌম আত্মমর্যাদা নিয়ে দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা। স্বাধীনতা প্রত্যেক জাতির অমূল্য সম্পদ। যে জাতি যেদিন স্বাধীনতা লাভ করে সেদিনটি জাতীয় জীবনে এক গৌরবান্বিত, আনন্দঘন ও তাৎপর্যময় দিন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস : স্বাধীনতা যে কোনো জাতির জন্যে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীনতা আমাদের সামনে স্বর্ণ দুয়ার খুলে দেয়। যে দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে আমরা আমাদের যুগসঞ্চিত জঞ্জাল দূর করার পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। স্বাধীনতা দিবস জাতীয় জীবনের একটি লাল তারিখ, স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের ২৬ এ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামের। ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ এ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নামের অন্তর্ভুক্তি ঘটে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এ দিনটিকে ঘিরে রচিত হয়েছে। এ দিনের নবীন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। স্বাধীনতা দিবস জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদার বর্ণিল স্মারক। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ আমরা বিশ্বের বুকে যে স্বাধীন সত্তার জানান দিয়েছিলাম, তা আজো মাথা উঁচু করে রেখেছে আমাদের। সে এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের জাতীয় জীবনে। সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রপুঞ্জের মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় ঘটনা কাহিনীর। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার জন্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। রক্তস্নাত দোঁআশ মাটি ভিত্তি করে আবির্ভাব ঘটেছিল নতুন করে এ জতির। যে যেভাবে পারে অংশগ্রহণ করেছিল এই মহান মুক্তিযুদ্ধে। এক অবিস্মরণীয় সম্মিলনের ঐকতানে মিলিত হয়েছিল এ জাতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঐকতানে সিম্ফনিতে মিলিত হয়েছিল সবাই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল এ স্বাধীনতা। আমরা ভুলি নি — ভুলি নি সেই বীরত্ব গাঁথা, ভুলিনি শহিদদের মহান আত্মত্যাগ।

 

অন্যান্য ঘটনা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশ্বের স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসে একটি আদর্শ –উজ্জ্বল দিক। কোনো জাতিকেই জন্মভূমির জন্য এতো করে এমনভাবে আত্মত্যাগ করতে হয় নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার মহান পতাকা এদেশের সুজলা – সুফলা – শস্য – শ্যামল ভূমিতে উঠাতে সক্ষম হয়েছিল। এজন্যে এ দেশের মানুষকে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় সংগ্রাম করতে হয়েছিল অস্ত্র সজ্জিত এক শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে। অবশেষে তারা সেই অকুতোভয় সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। ফলে আমরা লাভ করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ— ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’
স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি : ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ ব্রিটিশ — ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন এই স্বাধীন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং এটি তখন পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রত্যাশা ছিল তাদের সব ধরনের দমন – নিপীড়ন, অন্যায় – অত্যাচার শাষন – শোষনের অবসান ঘটবে। কিন্তু শোষণ ও বঞ্চণার অবসান হয়নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে পাকিস্তানি শাসকচক্র এ অঞ্চলে তাদের তাবেদারদের মাধ্যমে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। শোষণ – নিপীড়ন – নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল এদেশের মানুষ। তখন এদেশের মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শাসকচক্রের মুখোশ। তখন থেকেই বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা সঞ্চায়িত হতে থাকে।

 

আমাদের ভাষা – সাংস্কৃতিক – ভৌগলিক অবস্থান সবকিছুই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার বিপক্ষে। পাকিস্তান সৃষ্টির শুরুতেই আঘাত আসে আমাদের ভাষার ওপর। তৎকালীন শাসকচক্র উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে জোর করে ঘোষণা করলে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এদেশের ছাত্র সমাজ এবং সাধারন মানুষ। ১৯৪৭ সাল থেকে একটু একটু করে ভাষার জন্যে সঞ্চারিত হওয়া আন্দোলন আস্তে আস্তে বেগবান হয়ে চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালে। রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে এদেশের মানুষ তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের গরবিনি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে বীজ প্রোথিত করেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়ী ভাষা শহিদেরা, তারই স্মারক আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বোত্তম প্রাপ্তি বাঙালির — বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্বাধীন আবাসভূমি বাংলাদেশ।

 

স্বাধীনতা দিবস ও বিভিন্ন আন্দোলন : স্বাধীনতা একটি শব্দ শব্দ হলেও তা কখনোই একক কোনো দিবস বা কার্যের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। একে অর্জন করতে, একে পেতে হলে অনেক ত্যাগ অনেক আত্মহুতি অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও একদিনে আসে নি। কিংবা একক কোনো প্রচেষ্টার বিনিময়ে অর্জিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ঘটা বিভিন্ন দমন নিপীড়ন ও শোষণ বঞ্চনার প্রস্ফুট বিস্ফোরণের ফল হল আজকের স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের পশ্চাতে রয়েছে — ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনেরই অংশ। স্বৈরাচারী পাকিস্তান শাসক বারবার চেষ্টা করেও এদেশের মানুষকে দমন করতে পারে নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ কে ভোট দিয়েছিল, এ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও সরকার গঠন করতে পারে নি। নির্বাচনে জয়ের পরেও সংসদে বসতে দেয়নি পাকিস্তানি শাসকচক্র। তারা বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়নি। স্বৈরাচারী পাকিস্তান শাসকচক্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করেছিল। ফলে ক্ষমতায় যেতে পারে নি এদেশের মানুষ। প্রতিবাদে গর্জে উঠলো তারা। পাকিস্তানি হায়েনারা এদেশের ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাল, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রচনা করতে থাকলো একের পর এক বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়ল নিজেদের মুক্তির আন্দোলনে, জড়িয়ে পড়ল মহান মুক্তিযুদ্ধে।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস : ১৯৭১ সালের ২৫ এ মার্চ অন্ধকার রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র অবস্থায় অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা নির্বিচারে চালায় হত্যাযজ্ঞ। ২৫ এ মার্চ রাতে ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬ এ মার্চ যার যা আছে তাই নিয়ে সর্বত্র শত্রুর মোকাবিলা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করে যে যেভাবে পারেন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে একত্র হন। গ্রামে – গঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, কৃষক, সৈনিক, পুলিশ, আনসার সবাই মিলে যার যার অঞ্চলে আঞ্চলিক কমান্ড তৈরি করে বিক্ষিপ্তভাবে শত্রুর ওপর আক্রমন চালাতে থাকে। কতিপয় বিবেকহীন বিশ্বাসঘাতক আলবদর, রাজাকার, আল — শামস ছাড়া গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ —এ মার্চ চট্টগ্রামের বেতার কেন্দ্র হতে চট্টগ্রামের স্থানীয় জননেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২—৩ মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত ও অসংগঠিত অবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ চলতে থাকে।
১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব দেয়।

 

দেশের সমগ্র সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণকারী রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা কর্মীদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং শরণার্থী ক্যাম্প গড়ে উঠতে থাকে। চার পাঁচ মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের গতিবিধি ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর ভারত সরকার প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করা শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম বৈপ্লবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ দিকে দেশের অভ্যন্তরে পাক — হানাদার বাহিনীর ওপর চলে প্রচণ্ড গেরিলা আক্রমণ।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার জন্য এগারটি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত ও তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিপ্লবী অনুষ্ঠান ও রণসংগীত মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে এই যুদ্ধে উৎসাহিত করতে থাকে। প্রবাসী সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানায় এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে চলে। এমনিভাবে নয় মাস যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভূখণ্ড স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন : প্রতিবছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য আমরা ওই দিন ভোরে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পন করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। এ দিনের অনুষ্ঠানমালা আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে শাণিত ও উজ্জীবিত করে।

 

স্বাধীনতার চেতনা ও তাৎপর্য : আমাদের জাতীয় জীবনে এ দিনটির প্রধান তাৎপর্য হচ্ছে— এ দিনটি সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্বর। এই স্বাধীনতা দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর পর এখনো অসংখ্য লোক অশিক্ষিা ও দারিদ্র্য কবলিত অবস্থায় রয়েছে। জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। বেকারত্বের জালে আবদ্ধ যুবক বেছে নিচ্ছে নৈতিক অবক্ষয় ও সমাজবিরোধী পথ। এখনো আমরা আমাদের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সুখী – সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত করা।

 

পরিস্থিতি উত্তরণের উপায় : অজস্র রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যাতে কারো ব্যক্তিগত বা দলগত চোরাবালিতে পথ না হারায় সেই প্রচেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, স্বাধীনতা অর্জন করা কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা আরো কঠিন। আজ বিশ্বের দিকে দিকে উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতা। এক্ষেত্রে আমাদেরও সৃষ্টি করতে হবে উন্নয়নের ধারা। দেশ গড়ার কাজে আজ প্রয়োজন সমগ্র জাতির নতুন করে শপথ গ্রহণ। সর্বপ্রকার স্বৈরতন্ত্র থেকে থেকে দেশকে মুক্ত করে আত্মশক্তিকে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে।তবেই গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
স্বাধীনতা বনাম অপশক্তি : যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত চার দশকেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারে নি। স্বাধীনতার পর বার বার সামরিক অভ্যুত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী দেশি ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের অপতৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুব সমাজের মধ্যে সৃষ্ট হতাশা, বেকারত্বের হার, জনস্ফীতি, আইনশৃংখলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল্য লক্ষ্য বা চেতনাকে বিপন্ন করে চলছে। স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী কার্যকলাপ বার বার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাহিরে। প্রকৃত স্বাধীনতাকামী ও স্বাধীনপ্রিয় মানুষ তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার হতে বারবার বঞ্চিত হয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এজন্য দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন স্বাধীনতার প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের সত্যিকার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।

 

স্বাধীনতা দিবসে দেশবাসীর করণীয় : স্বাধীনতা দিবসে শপথ নিতে হবে যে, বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতাকে জাতীয় জীবনে স্থিতিশীল করে রাখার শথপ নিয়ে দেশ ও জাতির জন্যে আমরা আমাদের কাজ করে যাব। স্বাধীনতা দিবসের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতা দিবসের সত্যিকারের তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হব। আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, সংকট, অভাব, অনটন, অশিক্ষা, দারিদ্র্য দূর করে দেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সকল দিক থেকে অর্থবহ হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা এলেও অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো আসে নি। অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই স্বাধীনতা দিবসের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে, আমাদের সকলকে তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে, জাতির কল্যাণের জন্যে একত্রে কাজ করে যেতে হবে।
উপসংহার : স্বাধীনতা একজন মানুষের জন্মগত অধিকার। অনেক রক্ত, ত্যাগ — তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর জন্যে ৩০ লাখ মানুষকে শহিদ হতে হয়েছে, ২ লাখ মা—বোনকে তাদের ইজ্জত দিতে হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ স্বাধীনতাকে আমাদের যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে। সুখী, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারলে স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের স্বপ্ন পূরণ হবে।

আমাদের শেষ কথা

আপনারা আপনাদের প্রয়োজন এবং চাহিদা অনুসারে ২৬শে মার্চের রচনা, প্রবন্ধ ও অনুচ্ছেদ আমাদের এখান থেকে সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে পারেন। আমরা আশা করছি আপনাদের কাছে আমাদের এই আর্টিকেলটি অনেক ভালো লাগবে এবং আপনাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে। তবে আপনারা যদি স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কিত আরো অন্যান্য তথ্য জানতে চান অথবা আপনাদের মধ্যে যদি স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে আপনাদের মনে কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে আমাদেরকে কমেন্টের মাধ্যমে করতে পারেন। ধন্যবাদ।

Related Articles

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button